পদ্মশ্রী বিজয়ী বাংলার মেয়ে রেবা রক্ষিত , ভারতীয় প্রথম মহিলা বডি বিল্ডার:
Contents
১৯৩০ সালের অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লার এক হিন্দু পরিবারে জন্ম রেবার।
ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে মেয়ের ব্যাপক আগ্রহ ছিল খেলাধুলো শরীরচর্চার উপর। স্কুলে পড়ার সময়েই কলকাতায় চলে আসে তাঁর পরিবার। এসেই ভরতি হন এক যোগচর্চা কেন্দ্রে। নাম ‘জাতীয় ক্রীড়া ও শক্তি সংঘ’। তাঁর হাত ধরেই চলে আসা বিষ্টু ঘোষের আখড়ায়। তখন তাঁর বয়স মাত্র এগারো। ছাতিতে হাতি তোলার কেরামতির কারখানা ছিল এই বিষ্টু ঘোষের আখড়া বা ব্যায়ামাচার্য বিষ্ণুচরণ ঘোষের কৃতিত্ব। প্রথমে কয়েকদিন গিয়েই পালিয়ে এসেছিলেন। ভয়ে পেয়েছিলেন মেয়ে হয়ে তাঁর চেহারা ষণ্ডামার্কা হয়ে যাওয়ার ভয়ে। পড়ে দাদুর হার ধরে ফিরে যাওয়া আখড়ায়। বিষ্টুবাবু অভয় দিয়েছিলেন। কথা দিয়েছিলেন মেয়েকে ষণ্ডা নয় কিন্তু এমন ‘তন্দরুস্ত’ বানিয়ে দেবেন যে হাতির সমান হবে তাঁর শক্তি। চেহারা থাকবে একেবারেই সাধারণ।
পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিক থেকেই রেবা সার্কাসে খেলা দেখাতে শুরু করেন।
জীবনের নব অধ্যায়ের সূচনা এখান থেকেই। বিষ্টু ঘোষের হাত ধরে বুকের উপর দিয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে নেওয়া রপ্ত করে ফেলেছিলেন সহজেই। এরপরে যোগ শিক্ষকের মনে হয় ছাত্রী হাতি তুলতে পারে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখার। শহরে তাঁবু ফেলা এক সার্কাসের মালিকের সঙ্গে কথা বলে শো’য়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন। ট্রায়ালে ঠিক হয় পঞ্চাশ–ষাট মন ওজনের বাচ্চা হাতি রেবার বুকের উপর দিয়ে হেঁটে যাবে। ট্রায়ালে পাশ। অতএব ফাইনাল শো। বাড়ির সমস্ত বাধা ছুঁড়ে ফেলে মেয়ে চলে গেল বুকে হাতি তুলতে। চমক! বিশাল হাতি চলে গেল, নির্বিকার রইল মেয়ে। যেন কিছুই হয়নি।
খবর চাউর হয়ে যায়, একটা মেয়ে নাকি বুকে হাতি তুলছে।
তৎকালীন বোম্বের সার্কাস থেকে ডাক আসে। প্রথমে নিমরাজি ছিলেন অনেকেই। পরে মেনে নেন সবাই। ইন্টারমিডিয়েটের মেয়ে ফের চলল বুকে হাতি চাগাতে। বোম্বের সেই সার্কাস কলকাতায় তাঁবু ফেলল। ‘শো’ দেখতে এসেছিলেন স্পিকার শৈল মুখার্জী। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, বাঙালি মেয়ে হাতি চাগানোর ‘অজিব’ খেলা দেখবে বলে। মেয়ের চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন স্পিকার। এ খেলা দেখাতে মানা করেছিলেন। হাতি এক দুলকি চালে। হেঁটে চলে গেল মেয়ের বুকের উপর দিয়ে। তারপর মেয়ে সাধারণ ভাবেই উঠে দাঁড়াল। যেন সকালের আড়মোড়া ভাঙছে। নমস্কার করে মঞ্চ থেকে নামতেই শহরে হই হই কাণ্ড। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। হাতি চাগানো হয়ে গিয়েছিল রেবার সকাল বিকালের অভ্যাস। ছুটির দিনে তিন বেলা হাতির শো। নেপালের মহারাজাও একবার রেবার খেলা দেখতে এসেছিলেন।
তখনকার দিনে শো প্রতিদিন একশো পঁচিশ টাকা। উইক এন্ডে সেটাই হয়ে যেত ২০০ টাকা। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬২ টানা আট বছর ধরে একইভাবে দেশ বিদেশে ছাতিতে হাতি চাগানোর খেলা দেখাতেন যোগ বলে বলীয়ান মেয়ে। একসময় হাতির খেলা না থাকলে তাঁবু ফাঁকা যেত। হাতির পায়ের চাপে যখন শরীরে পড়ত সেই চাপ যে কি জিনিস রেবাই জানতেন। চোখের কোনে রক্ত জমতে শুরু করেছিল। ডাক্তার স্পষ্ট বলে দিলেন হাতির খেলা বন্ধ। শেষবার গুরু ব্যায়ামাচার্য বুকের উপর কাঠের পাটাতন রেখে মাথার শির চেপে ধরলেন। হাতি হেঁটে গেল। আবারও চমক, চোখের লাল দাগ সেরে গেল। তবে আর সার্কাসে খেলা দেখাননি রেবা।