সেটা ১৯৬৪ সালের কথা। লন্ডনের সেন্ট টমাস হাসপাতালের গবেষণাগার। মানুষের শরীরে প্রথম করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব জানা গেল। আর এই যুগান্তকারী কাজের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন এক মহিলা, জুন আলমিডা। তিনিই প্রথম চিহ্নিত করেছিলেন ‘করোনা ভাইরাস’। ভাইরোলজিস্ট জুন আলমিডা তখনই ভাইরাস ইমেজিংয়ের একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। ইলেকট্রন-মাইক্রোস্কোপের লেন্সে চোখ রেখে মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটানো করোনা ভাইরাস পর্যবেক্ষণের কাজে তিনিই পথিকৃৎ। ছাপান্ন বছর পরে আজকের করোনা ভাইরাসের এই মহামারির সময়ে আবার উঠে এল সেই কৃতবিদ্যের নাম।
জীবাণুজগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সদস্য তথা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি খালি চোখে দেখা যায় না, দেখতে গেলে মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণযন্ত্র প্রয়োজন। এসব কথা প্রায় সকলেরই জানা। সপ্তদশ শতাব্দীতে, সবেমাত্র মাইক্রোস্কোপির জন্মলগ্ন তখন, আন্তনি ফন লিউইয়েনহকের হাত ধরে শুরু হয়েছিল না-দেখতে-পাওয়া জীবাণু জগৎ দেখা। তখন সাধারণ মাইক্রোস্কোপে দ্রষ্টব্য কোনও ছোটো জিনিস ২৭০ গুণ বিবর্ধিত অবস্থায় দেখা যেত। সে সময়ের অতি সাধারণ মাইক্রোস্কোপ থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে ১৯৩৯ সাল নাগাদ উদ্ভাবিত হল উন্নত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। সাধারণ মাইক্রোস্কোপের বিবর্ধন ক্ষমতা এখন এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০০০-২০০০ গুণ। অন্য দিকে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে তিন লক্ষ গুণ বা তারও বেশি বড়ো করে দেখার ক্ষমতা। ব্যাকটেরিয়ার থেকেও হাজার গুণ ছোট ভাইরাস। তাই ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ছাড়া ভাইরাসের আকার বা গঠন দেখা সম্ভব নয়।
আর পাঁচজন গবেষক বিজ্ঞানীর মতো মসৃণ ছিল না জুনের জীবনের যাত্রাপথ। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর কাছে এক অঞ্চলে ১৯৩০ সালে জন্ম নেন জুন ড্যালজেইল হার্ট। অ্যালেক্সান্দ্রা পার্কের কাছে ভাড়া করা একটি ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে কাটানো ছোটবেলার একমাত্র সহায় ছিল বাস ড্রাইভার বাবার সামান্য উপার্জন। অভাবের সংসারের চেনা চিত্রনাট্য মেনে মাত্র ষোলো বছর বয়সে হাইস্কুল পাশ করেই থেমে গিয়েছিল জুনের পড়াশোনা। দু’চোখে স্বপ্ন আঁকা ছিল উচ্চশিক্ষার। দারিদ্র্যের কাছে যেভাবে স্বপ্ন হেরে যায়, জুনেরও তাই হল। তারপর শুরু হল জীবিকার খোঁজ। কলেজের ডিগ্রি নেই, কে নেবে তাকে কাজে? যাই হোক কাজ জুটল একটি। গ্লাসগো হাসপাতালে রয়্যাল ইনফার্মারি হিস্টোপ্যাথোলজি বিভাগে টেকনিসিয়ানের পদ। সেখানেই প্রথম পরিচয় হল মাইক্রোস্কোপের সঙ্গে। মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে বিভিন্ন টিস্যুর নমুনা বিশ্লেষণ করার কাজ। এখানেই জুন শিখে নিল কীভাবে রোগের জীবাণু চিনতে হয়। ভবিষ্যতের ভাইরাস ইমেজিং বিশেষজ্ঞ হওয়ার পথচলা সেই শুরু।
পেশাগত জীবনে আরও উন্নতির জন্যে গ্লাসগো থেকে লন্ডনে এলেন জুন। কাজ পেলেন সেন্ট বার্থেলেমিউ হাসপাতালে। ওখানেই পরিচয় হয় ভেনেজুয়েলান এক আর্টিস্টের সঙ্গে। কয়েক বছরের মধ্যেই যিনি হবেন তাঁর জীবনসঙ্গী। আবার স্থান পরিবর্তন। লন্ডন থেকে স্বামী এবং মেয়েকে নিয়ে অভিবাসী হয়ে কানাডার টরেন্টোতে গেলেন। সেখানে অন্টারিয়ো ক্যানসার ইন্সটিটিউটে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ যন্ত্রে পরীক্ষানিরীক্ষার কাজ পেলেন। মাইক্রোস্কোপের নিচে দৃশ্যমান অনেক কিছুর মধ্যে কাঙ্ক্ষিত ভাইরাসকে সুস্পষ্ট করে তোলা এবং চিহ্নিত করার পেছনে একদিকে যেমন লাগে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি প্রক্রিয়া ও জীবাণুবিদ্যায় জ্ঞান, সেইসঙ্গে প্রয়োজন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, নিবিষ্ট ধৈর্য আর নিরলস পরিশ্রম। টিস্যু নমুনার মধ্যে ভাইরাস শনাক্ত করা যথেষ্ট পরিশ্রম সাধ্য, একঘেয়ে এবং ক্লান্তিকর কাজ। প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি ব্যাপারে মনোযোগ দিয়ে টানা পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা করে যেতে হয় এ কাজে সফলতা পেতে গেলে। খুব কম সময়ের মধ্যেই মাইক্রোস্কোপে অণুজীব পর্যবেক্ষণ টেকনিকে জুনের দক্ষতা বৃদ্ধি পেল এবং অজানা সংক্রমণকারী জীবাণু চিহ্নিত করার কাজে একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেন জুন। সংক্রমণকারী জীবাণু, বিভিন্ন ভাইরাসের সুস্পষ্ট ছবি তুলে তাক লাগিয়ে দিলেন অন্য গবেষকদের। ইমেজের কনট্রাস্ট বাড়ানোর জন্যে ‘নেগেটিভ স্টেনিং’ প্রক্রিয়াটি আরও উন্নত করে তুললেন। বিজ্ঞানের জগতে প্রথাগত ডিগ্রি না থাকলেও কানাডাতে গবেষণাপত্রের লেখক হিসেবে মান্যতা পেলেন জুন, ব্রিটেনে সে সুযোগ ছিল না বললেই চলে।
মাইক্রোস্কোপের নিচে যে নমুনা (স্যাম্পেল) দেখা হবে তার প্রস্তুতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই প্রক্রিয়াটি নিখুঁত হওয়ার ওপর নির্ভর করবে দ্রষ্টব্য বস্তুর সুস্পষ্ট হয়ে ওঠা। মাইক্রোস্কোপে ভাইরাসকে ভালোভাবে দেখার জন্যে একটি সরল ও অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন জুন। কীরকম ছিল পন্থাটি? অ্যানিম্যাল অথবা মানুষের শরীরে সংশ্লিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি হতে সময় দিলেন প্রথমে। অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার পরে ওই ভাইরাস নমুনার সঙ্গে মেশালেন সেই অ্যান্টিবডি। আর এইভাবে অ্যান্টিবডি ঘিরে পুঞ্জিত হওয়া ভাইরাসকে মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে খুব ভালো ভাবে ভাইরাসের চেহারা বুঝতে পারা গেল। এই টেকনিকটি ‘ইমিউনো-ইলেকট্রন-মাইক্রোস্কোপি’ হিসেবে পরিচিত। প্রথম ‘রুবেলা’ ভাইরাস দেখলেন এই পদ্ধতিতে। এই সব মৌলিক এবং মেধাবী কাজ নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন জুন। এছাড়া হেপাটাইটিস ভাইরাসের যে দুটি আলাদা উপাদান, যার একটি বাইরের স্তরে এবং অন্যটি ভেতরে, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে জুনই প্রথম তা জানান। দারুণ কার্যকরী ভাইরাস শনাক্তকরণ পদ্ধতির জন্যে জুন আলমিডা তখন একটি পরিচিত নাম।
তাঁর অসাধারণ পারদর্শিতার কথা জেনে জুনের কাছে প্রস্তাব গেল ১৯৬৪ সালে লন্ডনের সেন্ট টমাস হাসপাতাল মেডিকেল কলেজে নিযুক্ত হওয়ার জন্যে। এই সেই হাসপাতাল যেখানে বছরখানেক আগে কোভিড আক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ভর্তি হয়েছিলেন। কানাডা থেকে আবার লন্ডনে ফিরে আসা। এখানে ফিরে এসে ড. ডেভিড টাইরেলের সহযোগী হিসেবে কাজ করা শুরু হল। ডেভিড সেসময় স্যালিসবারির কোল্ড ইন্সটিটিউটে ফ্লু নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন। ওই টিমে ছিলেন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক টনি ওয়াটারসন। তিনিই জুনকে ফিরিয়ে এনেছেন লন্ডনের ওই পুরনো ও ঐতিহ্যশালী সেন্ট টমাস হাসপাতালে। হেপাটাইটিস বি ও কোল্ড-ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছেন জুন। চলছে নতুন অর্গান কালচার নিয়ে গবেষণা। তাঁরা চেষ্টা চালাচ্ছিলেন কোষের মধ্যে রাইনো ভাইরাস চিহ্নিত করতে। টিস্যু কালচার ল্যাবে একদিন নতুন একধরণের ভাইরাসের খোঁজ পেলেন ডেভিড ও জুন। নমুনাটি নেওয়া হয়েছিল জ্বরে ভোগা এক স্কুল ছাত্রের নাক থেকে। এই অজানা জীবাণু যে অন্য রেসপিরেটরি ভাইরাল স্ট্রেনের থেকে আলাদা, তা বুঝতে পারা গেলেও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। এবার জুন তাঁর বুদ্ধিমত্তা আর নিপুণ অণুবীক্ষণ পারদর্শিতায় চিহ্নিত করতে সফল হলেন নতুন এই ভাইরাস। জুনের এই আবিষ্কারে ইতিহাস তৈরি হল সেন্ট টমাস মেডিকেল স্কুলে। আলমিডার চোখে মুখে অবাক বিস্ময় – অভিনব চেহারার সেই জীবাণু। যদিও প্রথমে অনেকেই মানতে চাননি, ভুল প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন জুন-এর সিদ্ধান্তকে। জুন তাঁর বিশেষজ্ঞ মতামত দিলেন – এটি ইনফ্লুয়েঞ্জা গোত্রেরই ভাইরাস, তবে পুরোপুরি ওই গোত্রের সেটাও বলা যাবে না। ড. আলমিডা, ড. টাইরেল এবং প্রফেসর টনি ওয়াটারসন তিনজনে মিলে নতুন এই ভাইরাসের নাম দিলেন – ‘করোনা ভাইরাস’ – মাইক্রোস্কোপের তলায় ভাইরাসের চেহারা ক্রাউনের (রাজ মুকুট) মতো দেখতে বলে।
গবেষণাপত্র লিখে এবার প্রকাশের জন্যে পাঠালেন জুন। জার্নালের দপ্তর তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশের অযোগ্য বিচার করে নাকচ করে দিল! শুধু নাকচ করাই নয়, জার্নালের মূল্যায়নকারী বিশারদরা মন্তব্য জুড়ে দিলেন – ‘যে ফোটোগ্রাফের ওপর ভিত্তি করে গবেষকদের এই দাবী, বস্তুত তা একটি অতি নিম্নমানের ফ্লু-ভাইরাস পার্টিকলের ছবি’। হায় নিয়তি! তাঁরা স্বপ্নেও ভাবেননি যে আরও পঞ্চাশ বছর পরে এই বাতিল ছবির ভাইরাসটিই সারা পৃথিবীতে আলোড়ন তুলবে একদিন।
হতাশ হলেও জুন যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তাঁর কাজে। দু’বছর পরে প্রথমে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে এবং সেই ভাইরাসের ছবি দু’বছর পরে জার্নাল অফ জেনারেল ভাইরোলোজি গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হল। বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করালেন ওই নতুন ভাইরাসকে। আলমিডা করোনাভাইরাস ছাড়াও ইঁদুরের সংক্রমণকারী হেপাটাইটিস ভাইরাস কিংবা মুরগীর সংক্রমণকারী ব্রংকাইটিস জীবাণু শনাক্ত করেছিলেন।
কানাডায় টরেন্টোর অন্টারিয়ো ক্যানসার ইন্সটিটিউটে থাকাকালীন তাঁর প্রকাশিত গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে ১৯৬৭ সালে জুন আলমিডাকে ডক্টরেট অফ সায়েন্স (ডি.এসসি) উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হল। তারপর জুন তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান রয়্যাল পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিকেল স্কুলে, যেটি পরবর্তী সময়ে ইম্পেরিয়েল কলেজ স্কুল অফ মেডিসিনের অংশ হয়। আলমিডা তাঁর কেরিয়ার শেষ করেছিলেন লন্ডনের ওয়েলকাম ইন্সটিটিউটে, যেখানে ভাইরাস ইমেজিং বিভাগে তাঁর একাধিক পেটেন্টের অধিকারী হন তিনি।
পড়াশোনার খরচ চালাতে না পারার জন্যে ষোল বছর বয়সে যে মেয়েটিকে একদিন পড়াশোনা ছেড়ে জীবিকার জন্যে যোগ দিতে হয়েছিল সামান্য এক টেকনিসিয়ানের কাজে। অদম্য উৎসাহ, মেধা আর নতুন বিষয় জানার অফুরন্ত চেষ্টা – সেই মেয়েটিকে একদিন ভাইরোলজির পথিকৃৎ হিসেবে মান্যতা দিয়েছে। এ এক অভাবনীয় উত্তরণের কাহিনি। অন্ধকারের তলানিতে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন সত্যি হওয়ার কাহিনি।